খেজুর গুড় এক ধরনের গুড় যা শিতকালে খেজুর গাছের খেজুরের রস থেকে তৈরি করা হয়। বাংলা মাসের অগ্রহায়ণ মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। আগুনের উত্তাপে খেজুরের রসকে ঘন করে গুড়ে পরিণত করা হয় এবং শক্ত করে পাটালি তৈরি করে । বিভিন্ন ধরন অনুযায়ী খেজুরের গুড়কে দানাগুড়, পাটালি, ঝোলা গুড়, , চিটাগুড় ইত্যাদি ভাগে ভাগে ভাগ করা যায়। খেজুর রস ও গুড় এবং গুড়ের পাটালি খুবই সুস্বাদু। শীতকালে খেজুরের রস ও গুড় দিয়ে পায়েস এবং বিভিন্ন ধরনের শীতকালীন পিঠা, তালের পিঠা, খেজুর গুড়ের জিলাপি ইত্যাদি খাওয়ার তৈরি করা হয় ।
এই পোস্টের সূচীপত্র
👉 খেজুরের রস ও গুড়ের প্রাপ্তিস্থান👉 খেজুর রস আহরণের নিয়ম
👉 আখের গুড় না খেজুরের গুড় কোনটা বেশি উপকার
👉 শীতে গুড় খেলে যে সকল রোগ কাছেও ঘেঁষবে না
👉 খেজুরের খাঁটি গুড় চেনার সেরা উপায়
👉 আসল গুড় চেনার আরও একটি উপায়
👉 শীতে গুড় খেলে যে সকল রোগ কাছেও ঘেঁষবে না
👉 খেজুরের খাঁটি গুড় চেনার সেরা উপায়
👉 আসল গুড় চেনার আরও একটি উপায়
খেজুরের রস ও গুড়ের প্রাপ্তিস্থান
বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে এবং ভারতের কিছু অঞ্চলে খেঁজুরের গুড় পাওয়া যায়। এক সময় এ খেজুরের রস থেকে চিনি তৈরি করা হতো। বৃহত্তর যশোর ও ফরিদপুর জেলা, নদীয়া জেলার কিছু অংশ, বসিরহাট ও সাতক্ষীরা মহকুমায় এবং চব্বিশ পরগনায় ব্যাপকভাবে খেজুর গাছের চাষ হতো। এখনও এসব এলাকাতেই খেজুরের গুড় বেশি উৎপাদিত হয়। ১৯৪০-এর দশকের প্রথম দিকে চবিবশ পরগনার হাওড়া, মেদিনীপুর এবং ফরিদপুর জেলাগুলিতে এ শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটে। তৎকালীন সময়ে প্রতি বছর মোট ১,০০,০০০ টন গুড় উৎপাদিত হতো। ১ বিঘা জমিতে ১০০টি গাছ লাগানো যায়। সাত বছরের মধ্যে গাছগুলি ফল ও রস সংগ্রহের উপযোগী হয় এবং ত্রিশ/চল্লিশ বছর পর্যন্ত ফলন দেয়।
খেজুর রস আহরণের নিয়ম
একটি খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের পূর্বে অগ্রহায়ণের শেষের দিকে গাছের কান্ডের একেবারে উপরের অংশে পাতাসম্বলিত বাকলগুলি ধারালো দা দিয়ে চেঁছে পরিষ্কার করা হয় যাকে আমাদের গ্রামের ভাষায় গাছ তোলা বলে। সাত থেকে আট দিন পরে পুনরায় পরিষ্কার করা হয়। গাছ তোলার দুই সপ্তাহের মাথায় চাঁছা অংশ কিছুটা কেটে নলি অর্থাৎ বাঁশের নল ও খিল লাগিয়ে এবং সম্মুখভাগে হাঁড়ি বা ভাড় ঝুলিয়ে দিয়ে রস সংগ্রহ করা হয়।
রস আহরণের সময়কালের উপর ভিত্তি করে খেজুরের রসকে জিড়ান, দোকাট এবং ঝরা এই তিনভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। প্রথম রাতের গুণে ও মানে সর্বোৎকৃষ্ট এবং পরিমাণেও সর্বোচ্চ রসকে বলা হয় জিড়ান বা বলা হয় সন্ধ্যার রস এই সন্ধ্যার রসে বেশ চাহিদা রয়েছে অনেকেই এই রস খেতে পছন্দ করে। পরদিন বিকালে গাছের চোখ বা কাটা অংশটুকু দা এর সাহায্যে চেছে পরিষ্কার করা হয় এবং দ্বিতীয় রাত্রের নির্গত রসকে বলা হয় দোকাট আর এই দোকাট রস দিয়েই গুড় তৈরি করে। দোকাটের রস জিড়ানের মতো সুস্বাদু কিংবা মিষ্টি নয় এবং পরিমাণেও হয় কম। তৃতীয় রাতে প্রাপ্ত রসকে ঝরা রস বলা হয়। ঝরা রস দোকাটের চেয়েও পরিমাণে কম এবং কম মিষ্টি। অনেক ক্ষেত্রে ঝরা রস টক স্বাদযুক্ত হয়। পরবর্তী তিনদিন গাছকে অবসর দেওয়া হয়। এরপর আবার নতুন করে চাঁছা (কাটা) ও রস সংগ্রহ করা হয়। খেজুরের রস আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে। আবহাওয়া যদি প্রচুর ঠান্ডা হয় এবং পরিচ্ছন্ন মেঘলা মুক্ত আকাশ থাকে তাহলে রস পরিষ্কার ও মিষ্টি হয়। মেঘলা গুমোট রাতে খেজুরের রসে টকভাব আসে। নভেম্বরের প্রথম দিকে রস আহরণ শুরু হলেও ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাসে সর্বাধিক পরিমাণে পাওয়া যায়।
খেজুর রস থেকে গুড় তৈরীর প্রক্রিয়া
খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করার পর তা বড় পাত্রে সংরক্ষণ করা হয় এবং তা কিছুক্ষণ স্থির ভাবে রেখে দিয়ে জ্বাল দেওয়া হয়। এই রস আগুনের তাপে ফুটে ওঠে এবং গুড়ে পরিণত হয়।
সাধারণ অবস্থায় খেজুরের রস দীর্ঘসময় রেখে দিলে গাঁজন প্রক্রিয়ার ফলে তা নষ্ট হয়ে যায়। এই গাঁজনের মাধ্যমে খেঁজুরের রস থেকে তাড়ি বা দেশীয় মদ প্রস্তুত করা হয়। একটি বড় পাত্র বা তাফালে গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস ছেকে জ্বাল দেয়া হয়। এক পর্যায়ে রস ঘন হয়ে ঝোলা গুড়ে পরিণত হয়। পাটালি গুড় তৈরি করার জন্যে নির্দিষ্ট পরিমাণে ঘণ করার পরে তা ছাঁচে ঢেলে দেয়া হয় গুড়কে খুব বেশি জ্বাল দিলে চিংড়ি তৈরী হয় যা একদা গ্রাম বাংলা চকোলেট, দেলবাহার ইত্যাদি নামে বিক্রি হয়।
আরও জানুন
পুঁইশাকের উপকারিতা ও অপকারিতাআখের গুড় না খেজুরের গুড় কোনটা বেশি উপকার
আখের গুড়ের ব্যবহার তো সারা বছরই চলে। কোন গুড়ের গুণাগুণ কেমন তা জানালেন পুষ্টিবিদ আখতারুন্নাহার আলো।
আখের গুড়
আখের গুড়ে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি আর শর্করা থাকে। এ জন্য আখের গুড় ডায়রিয়ার রোগীকে আখের গুড়ের স্যালাইন খাওয়ানো হয়। কারণ শর্করা শরীরের পানিটাকে ধরে রাখতে সাহায্য করে। তবে যাদের ওবেসিটি আছে, তাঁদের আখের গুড় না খাওয়াই ভালো। ক্যালরি বেশি থাকার কারণে আখের গুড় দ্রুত ওজন বাড়াতে বেশ কার্য্যকরি ভূমিকা রাখে ।
খেজুরের গুড়
খেজুরের গুড়ে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, আয়রন ও ম্যাগনেসিয়াম থাকে। যাঁরা রক্তস্বল্পতার ভুগছেন, তাঁরা খেজুরের গুড় খেলে উপকার পাবেন। হাড় ও বাতের ব্যথা কমাতে খেজুরের গুড় বেশ উপকারী। খেজুরের গুড় শরীরের ভেতর থেকে চুল ও ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করে। তবে যাঁদের ডায়াবেটিস আছে, তাঁদের খেজুরের গুড় খাওয়া একেবারেই নিষেধ।
শীতে গুড় খেলে যে সকল রোগ কাছেও ঘেঁষবে না
আরও দেখুন
মাইগ্রেন কি কেনো হয় এবং হলে করনীয় কি
তুলসী পাতার উপকারিতা ও তুলসী পাতা খাওয়ার নিয়ম
চিনির বিকল্প হিসেবে গুড় স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো। গরমের সময়ে শসা ও তরমুজ যেমন শরীর শীতল রাখে, তেমনি শীতে শরীরের জন্য গুড় খুবই উপকারী।গুড় সাধারণ যে কোনো অসুখ থেকে রক্ষা করতে শরীরকে শক্তি জোগায়। আখ ও খেজুরের রস থেকে আমাদের দেশে গুড় তৈরি করা হয়। গুড় যেহেতু প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয় তাই এর উপকারিতাও অনেক বেশি। শীতকালে গুড় খাওয়ার উপকারিতা নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন পুষ্টিবিষয়ক একটি ওয়েবসাইট। সেই তথ্য অনুযায়ী আসুন জেনে নিই শীতে গুড় খাওয়ার উপকারিতা-
- গুড় রক্ত পরিষ্কার করে। হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ায়। আর অবাঞ্ছিত উপাদান দূর করতে সাহায্য করে।
- গুড় শরীর থেকে অবাঞ্ছিত উপাদান দূর করে পাকস্থলী, অন্ত্র, ফুসফুস ও খাদ্যনালি সুস্থ রাখতে বেশ কার্য্যকরি ভূমিকা পালন করে।
- শীতে গুড় খাওয়া শরীরের জন্য বেশ ভালো। গুড় খেলে শরীর সুস্থ থাকে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
- গুড় তাপ উৎপাদন করে শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করে। এতে আছে উচ্চ মানের ক্যালোরিফিক, যা শরীর উষ্ণ রাখে এবং শক্তি যোগান দেয়।
- সর্দি-কাশি ও সাধারণ ঠাণ্ডার কারণে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ কার্য্যকরি এই গুড়। ক্ষতিকর অনুজীব বৃদ্ধি হ্রাস করতেও সাহায্য করে।
- গুড়ে রয়েছে জিংক, ম্যাগনেসিয়াম, লৌহ, সেলেনিয়াম এবং পটাশিয়াম। যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও সংক্রমণ থেকে দূরে রাখে।
- কফ, গলাব্যথা, ফোলা বা খুসখুস করা দূর করতে সাহায্য করে গুড়। এ ছাড়া শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা যেমন-কফ, বা বুকে কফ জমাট বাঁধা, রক্ত প্রবাহে সমস্যা ইত্যাদি দূর করতেও সাহায্য করে।
আরও পড়ুন
তুলসী পাতার উপকারিতা ও তুলসী পাতা খাওয়ার নিয়ম
ঠান্ডা সর্দি সারাতে জেনে নিন ঘোরোয়া উপায়
স্বাস্থ্য ভালো রাখার কার্যকরি উপায়
খেজুরের খাঁটি গুড় চেনার সেরা উপায়
পৌষ মাসে ঘরে ঘরে শুরু হয় পিঠা-পুলির উৎসব। এসব পিঠা বানাতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে খেজুরের খাঁটি গুড়। খেজুরের গুড়ের ঘ্রাণ পিঠার স্বাদ বাড়ায়।
তবে খাঁটি গুড়ের পাশাপাশি ভেজাল গুড়ও রয়েছে বাজারে। তাই খেজুরের খাঁটি গুড় চেনা খুবই প্রয়োজন। খাঁটি খেজুরের গুড় দিয়ে পিঠা বানালে খাবারের স্বাদ ও গন্ধ থাকে অটুট। তবে গুড়ে আদৌ কোনো ভেজাল আছে কিনা তা সহজেই বোঝা যায় কিছু কৌশল জানা থাকলে ।
আসুন জেনে নিই কীভাবে চিনবেন খেজুরের খাঁটি গুড়-
- কেনার সময় একটু গুড় ভেঙে মুখে দিয়ে দেখুন। জিভে নোনতা স্বাদ লাগলে বুঝবেন এই গুড় খাঁটি নয়।
- গুড় কেনার সময় গুড়ের ধারটা দুই আঙুল দিয়ে চেপে দেখবেন। যদি নরম লাগে, বুঝবেন গুড়টি বেশ ভালো মানের। ধার কঠিন হলে গুড় না কেনাই বুদ্ধিমানের কাজ।
- যদি গুড় একটু হালকা তিতা স্বাদের হয়, তবে বুঝতে হবে গুড় বহু ক্ষণ ধরে জ্বাল দেয়া হয়েছে। তাই একটু তিতকুটে স্বাদ নিয়েছে। স্বাদের দিক থেকে এমন গুড় খুব একটা সুখকর হবে না।
- গুড় যদি স্ফটিকের মতো তকতকে দেখতে হয়, তবে বুঝবেন– গুড়টি যে খেজুর রস দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল তার স্বাদ খুব একটা মিষ্টি ছিল না।
- সাধারণত গুড়ের রঙ গাঢ় বাদামি হয়। হলদেটে রঙের গুড় দেখলেই বুঝতে হবে তাতে অতিরিক্ত রাসায়নিক মেশানো হয়েছে।
আসল গুড় চেনার আরও একটি উপায়
যশোরের বাঘারপাড়া পৌরসভার মধ্যপাড়া এলাকার কৃষক শমসের আলী ৩৫ বছর ধরে রস সংগ্রহের জন্য খেজুরগাছ কাটেন। তিনি বলেন, ভেজাল গুড়-পাটালি চকচক করে। গুড়ের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে পাটালি তৈরি করলে সেটা খুব শক্ত হয়। রসাল থাকে না। পাটালির রং কিছুটা সাদা হয়ে যায়। গুড়ে হাইড্রোজ, ফিটকিরি ব্যবহার করলেও পাটালির রং সাদা হয়। পাটালি ভীষণ শক্ত হয়। তিনি বলেন, আসল খেজুর গুড়ের পাটালি চকচক করে না। খাঁটি পাটালির রং হয় কালচে লাল। সেটা নরম ও রসাল থাকে। অনেক সময় পাটালির ওপরের অংশ কিছুটা শক্ত হতে পারে, কিন্তু ভেতরটা রসাল হয়।
0 Comments