কালোজিরা শুধু ছোট ছোট কালো দানা নয়, এর মধ্যে রয়েছে বিস্ময়কর শক্তি। প্রাচীনকাল থেকে কালোজিরা মানবদেহের বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক। আমাদের নানা রকমের রান্নাবান্নায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উপাদান হলো কালো জিরা। তবে শুধু রান্নার স্বাদ বাড়াতেই নয়, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাতেও প্রাচীন কাল থেকেই এর ব্যবহার হয়ে আসছে। কালোজিরাতে আছে ফসফেট,লৌহ ও ফসফরাস। এছাড়াও রয়েছে ক্যানসার প্রতিরোধক কেরটিন, বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধকারী উপাদান এবং অম্ল রোগের প্রতিষেধক।
কালোজিরা ইংরেজি নাম Black Caraway, also known as Black Cumin, Nigella, Kalojeere, এবং Kalonji)একটি মাঝারি আকৃতির মৌসুমী গাছ, একবার ফুল ও ফল হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Nigella Sativa Linn। এর স্ত্রী, পুরুষ দুই ধরনের ফুল হয়, রং সাধারণত হয় নীলচে সাদা (জাত বিশেষে হলুদাভ), পাঁচটি পাঁপড়ি বিশিষ্ট । কিনারায় একটা বাড়তি অংশ থাকে। তিন-কোনা আকৃতির কালো রং এর বীজ হয় । গোলাকার ফল হয় এবং প্রতিটি ফলে ২০-২৫ টি বীজ থাকে । আয়ুর্বেদীয় , ইউনানী, কবিরাজী ও লোকজ চিকিৎসায় ব্যবহার হয়। মশলা হিসাবে ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে, এটি পাঁচ ফোড়নের একটি উপাদান। বীজ থেকে পাওয়া যায় তেল।
কালোজিরার উপাদান সমূহ
এর প্রধান উপাদানের মধ্যে
- আমিষ ২১ শতাংশ
- শর্করা ৩৮ শতাংশ
- স্নেহ বা ভেষজ তেল ও চর্বি ৩৫ শতাংশ।
এছাড়াও ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ আছে। প্রতি গ্রাম কালিজিরা পুষ্টি উপাদান হলো-
- প্রোটিন ২০৮ মাইক্রোগ্রাম
- ভিটামিন বি১ ১৫ মাইক্রোগ্রাম;
- নিয়াসিন ৫৭ মাইক্রোগ্রাম;
- ক্যালসিয়াম ১.৮৫ মাইক্রোগ্রাম;
- আয়রন ১০৫ মাইক্রোগ্রাম;
- ফসফরাস ৫.২৬ মিলিগ্রাম;
- কপার ১৮ মাইক্রোগ্রাম;
- জিংক ৬০ মাইক্রোগ্রাম;
- ফোলাসিন ৬১০ আইউ।
কালিজিরার অন্যতম উপাদানের মধ্যে আরও আছে
- নাইজেলোন, থাইমোকিনোন ও স্থায়ী তেল।
এছাড়াও কালিজিরার তেলে রয়েছে
- লিনোলিক এসিড,
- অলিক এসিড,
- ফসফেট,
- লৌহ,
- ফসফরাস,
- কার্বোহাইড্রেট,
- ক্যালসিয়াম,
- পটাশিয়াম,
- আয়রন,
- জিংক,
- ম্যাগনেশিয়াম,
- সেলেনিয়াম,
- ভিটামিন-এ,
- ভিটামিন-বি,
- ভিটামিন-বি২,
- নিয়াসিন
এবং রয়েছে ভিটামিন-সি এছাড়াও জীবাণুনাশক বিভিন্ন উপাদান রয়েছে এই কালোজিরাতে যা হাজারও উপকার করে মানব শরীরের
কালো জিরাতে রয়েছে একাধিক আশ্চর্য স্বাস্থ্যগুণ, আসুন কালো জিরার আশ্চর্য সব উপকারি গুণ সম্পর্কে জেনে নিই
পেটের সমস্যা
সমস্যায় খাবারের পাতে রাখুন কালো জিরা। ভাজা কালো জিরা গুঁড়ো করে আধা কাপ দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে পারলে তা পেটের অনেক সমস্যা দূরে রাখতে সাহায্য করে।
রোগ প্রতিরোধে ক্ষমতা
কালো জিরাতে থাকা ফসফরাস শরীরের রোগ প্রতিরোধে ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। শরীরে যেকোনো জীবাণুর সংক্রমণ ঠেকাতে কালো জিরা অত্যন্ত কার্যকরী।
প্রস্রাবের ইনফেকশন
কালো জিরা দুর্দান্ত অ্যান্টি টক্সিনের কাজ করে। তাই নিয়মিত ও পরিষ্কার প্রস্রাবের জন্য পাতে রাখুন কালো জিরে। মুত্রথলির সংক্রমণ ঠেকাতেও কালো জিরা খুবই কার্যকরী!
চোখের সমস্যা কালোজিরা
রাতে ঘুমানোর আগে চোখের উভয়পাশে ও ভুরুতে কালোজিরার তেল মালিশ করুণ। এক কাপ গাজরের রসের সঙ্গে এক মাস কালোজিরা তেল সেবন করুন।
উচ্চ রক্তচাপ
যখনই গরম পানীয় বা চা পান করবেন, তখনই কালোজিরা খাবেন। গরম খাদ্য বা ভাত খাওয়ার সময় কালোজিরার ভর্তা খান রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকবে। এ ছাড়া কালোজিরা, নিম ও রসুনের তেল একসঙ্গে মিশিয়ে মাথায় ব্যবহার করুণ। এটি ২-৩ দিন পরপর করা যায়।
মাথাব্যথা
অনেকেরই বর্ষাকালে মাথা যন্ত্রণা বা মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। এ ক্ষেত্রে একটা কাপড়ে কালো জিরা বেঁধে তা রোদে শুকাতে দিন। এরপর তা নাকের কাছে ধরলে মাথায়, বুকে জমে থাকা শ্লেষ্মা সহজেই বেরিয়ে যায়। আর মাথা যন্ত্রণার অস্বস্তিও কমে যায়।
এবং-
মাথাব্যথায় কপালে উভয় চিবুকে ও কানের পার্শ্ববর্তী স্থানে দৈনিক ৩-৪ বার কালোজিরার তেল মালিশ করুণ। তিন দিন খালি পেটে চা চামচে এক চামচ করে তেল পান করুন উপকার পাবেন।
যৌন দুর্বলতা
কালোজিরা চুর্ণ ও অলিভ অয়েল, ৫০ গ্রাম হেলেঞ্চার রস ও ২০০ গ্রাম খাঁটি মধু একসঙ্গে মিশিয়ে সকালে খাবারের পর এক চামুচ করে খান। এতে গোপন শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
চুলপড়া
লেবু দিয়ে সব মাথার খুলি ভালোভাবে ঘষুণ। ১৫ মিনিট পর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন ও ভালোভাবে মাথা মুছে ফেলুন। তার পর মাথার চুল ভালোভাবে শুকানোর পর সম্পূর্ণ মাথার খুলিতে কালোজিরার তেল মালিশ করুন। এতে এক সপ্তাহেই চুলপড়া কমে যাবে।
কফ ও হাঁপানি
বুকে ও পিঠে কালোজিরার তেল মালিশ করুন। এ ক্ষেত্রে হাঁপানিতে উপকারী অন্যান্য মালিশের সঙ্গে এটি মিশিয়েও নেয়া যেতে পারে। কালো জিরাতে থাকা আয়রন আর ফসফেট শরীরে অক্সিজেনের ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা থেকে রেহাই পেতে পথ্য হিসেবে কালো জিরা খুবই কার্যকরী।
স্মৃতিশক্তি বাড়ে ও অ্যাজমায় উন্নতি ঘটে
এক চামচ মধুতে একটু কালোজিরা দিয়ে খেয়ে ফেলুন। এতে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। হালকা উষ্ণ পানিতে কালোজিরা মিলিয়ে ৪৫ দিনের মতো খেলে অ্যাজমার সমস্যার উন্নতি ঘটে।
ডায়াবেটিস
কালোজিরার চূর্ণ ও ডালিমের খোসা চূর্ণ মিশ্রণ এবং কালোজিরার তেল ডায়াবেটিসে উপকারী।
মেদ ও হৃদরোগ
চায়ের সঙ্গে নিয়মিত কালোজিরা মিশিয়ে অথবা এর তেল মিশিয়ে পান করলে হৃদরোগে যেমন উপকার হয়, তেমনি মেদ কমে যায়।
অ্যাসিডিটি ও গ্যাস্টিক
এক কাপ দুধ ও এক টেবিল চামুচ কালোজিরার তেল দৈনিক তিনবার ৫-৭ দিন সেবন করতে হবে। এতে গ্যাস্টিক কমে যাবে।
জ্বর
সকাল-সন্ধ্যায় লেবুর রসের সঙ্গে এক টেবিল চামুচ কালোজিরা তেল পান করুণ। আর কালোজিরার নস্যি গ্রহণ করুন।
স্ত্রীরোগ
প্রসব ও ভ্রুণ সংরক্ষণে কালোজিরা মৌরী ও মধু দৈনিক ৪ বার খান।
বাত ব্যাথা সারাতে কালোজিরা
পিঠে ও অন্যান্য বাতের বেদনায় কালোজিরার তেল মালিশ করুন। এ ছাড়া মধুসহ প্রতিদিন সকালে কালোজিরা সেবনে স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
দাঁত শক্ত করে
দই ও কালোজিরার মিশ্রণ প্রতিদিন দুবার দাঁতে ব্যবহার করুন। এতে দাঁতে শিরশিরে অনুভূতি ও রক্তপাত বন্ধ হবে।
ওজন কমায়
যারা ওজন কমাতে চান, তাদের খাদ্য তালিকায় উষ্ণ পানি, মধু ও লেবুর রসের মিশ্রণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এখন এই মিশ্রণে কিছু কালোজিরা পাউডার ছিটিয়ে দিন। পান করে দারুণ উপকার পাবেন।
সৌন্দর্য বৃদ্ধি
অলিভ অয়েল ও কালোজিরা তেল মিশিয়ে মুখে মেখে এক ঘণ্টা পর সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলন।
কালিজিরা ফুলের মধু উৎকৃষ্ট মধু হিসেবে বিশ্বব্যাপী বিবেচিত, কালোজিরার তেল আমাদের শরীরের জন্য অনেক উপকারী। বর্তমানে কালিজিরা ক্যাপসুলও বাজারে পাওয়া যায়।
কালিজিরার ব্যবহার কৌশল কালিজিরা মসলা হিসেবে ব্যাপক ব্যবহার হয়। এটি পাঁচ ফোড়নের একটি উপাদান। কালিজিরা সরাসরি তেল হিসেবে, কাঁচা চিবিয়ে, ভেজে পরিমাণমতো খাওয়া যায়। সরাসরি খাওয়ার থেকে শুরুতে ভাত রুটি বা মুড়ির সাথে কালিজিরা খাওয়াটা অভ্যাস করতে পারলে ভালো। যখনই গরম পানীয় বা চা পান করা হয় তখনই কালিজিরা কোনো না কোনোভাবে সাথে খাওয়া ভালো। গরম খাদ্য বা ভাত খাওয়ার সময় কালিজিরা বেশ উপকারী।
আরও জানুন -
মধু খাওয়ার নিয়ম এবং মধুর অসাধারণ গুনাগুন
তুলসী পাতার উপকারিতা ও তুলসী পাতা খাওয়ার নিয়ম
লেবু খাওয়ার উপকারিতা ও লেবুর পুষ্টিগুন
গরম পানি খাওয়ার নিয়ম ও গরম পানির উপকারিতা
লাল চা খাওয়ার নিয়ম ও লাল চায়ের উপকারীতা
বৃষ্টির পানির উপকার ও ব্যবহারের নিয়ম
দাতের ব্যথায় করনীয় এবং ঘরোয়া টোটকামাইগ্রেন কি কেনো হয় এবং হলে করনীয় কি
কালোজিরা খাওয়ার সতর্কতা
কালোজিরা নিয়মিত ও পরিমিত খেতে হয়। অতিরিক্ত খুব বেশি খেলে বা ব্যবহার করলে হিতের বিপরীত হয়। কালোজিরার তেল গর্ভাবস্থায় গ্রহণ করা যাবে না। গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত কালোজিরা খেলে গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকে। কালোজিরা গ্রহণ করার সবটাই করতে হবে পরিমিত পর্যায়ে। অনেকেই কালোজিরা হজম করতে পারেন না। তবে আস্তে আস্তে অভ্যাস করলে ভালো। যারা সহজে কালোজিরা হজম করতে পারেন না তারা খাবেন না, যারা পারেন তারাই নিয়মিত পরিমিত খাবেন। গর্ভাবস্থায় ও দুই বছরের কম বয়সের বাচ্চাদের কালোজিরার তেল সেবন করানো উচিত নয়। নকল বা কৃত্রিম কালিজিরার তেল কখনও খাওয়া ঠিক না। জেনে শুনে বুঝে নিশ্চিত হয়ে কালোজিরা বা কালোজিরার তেল সরাসরি বা প্রক্রিয়াজাত করে খেতে হবে। পুরনো কালোজিরা তেল স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক।
0 Comments