আরবি শব্দ ‘কোরবান’ থেকে আগত কোরবানি’ শব্দটি । যার অর্থ উৎসর্গ করা বা sacrifice । অন্যভাবে বললে কোরবানির অর্থ নিকটবর্তী হওয়া। কোরবানির ঈদে বান্দাগন আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রাণী বা পশু উৎসর্গ করে আল্লাহর পরম নৈকট্য লাভের এক সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে থাকে। তাই যারা সামর্থ্যবান তারা উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় পশু কোরবানি করতে প্রচেষ্টা চালায়। শর্ত মেনে কোরবানি দিতে পারলে লাভ করা যায় অশেষ ফজিলত। হজরত যায়েদ বিন আরক্বাম (রা.) বলেন, রাসূল (স.)-এর সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কোরবানিটা কী এবং কোরবানি দিলে আমাদের জন্য কেমন ফায়েদা রয়েছে ? হযরত মোহাম্মদ সাল্লালহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে বললেন, তোমাদের পিতা ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত এবং আদর্শ। (কোরবানির পশুর) প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি রয়েছে। সাহাবিরা আবার জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রাসূল ( সাঃ ) ! ভেড়া বা দুম্বার পশমের ব্যাপারে কী কি নিয়ম? তিনি বললেন, দুম্বা এবং ভেড়ারও প্রতিটি পশমের বিনিময়েও এক একটি নেকি রয়েছে। (ইবনু মাজাহ)।
কোরবানি দেওয়া হলো একটি আর্থিক ইবাদত। আর এই আর্থিক ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য রয়েছে প্রধান দুটি শর্ত। যা অবশ্যই মানতে হবে সবাইকে ।
কোরবানির প্রথম শর্তঃ
খাঁটি নিয়তে কোরবানি দিতে হবে বা কোরবানি দেয়ার নিয়ত অবশ্যই সঠিক হতে হবে। তাই কোরবানি হতে হবে অবশ্যই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য। কারো মনোরঞ্জন বা নিজের সম্মান রক্ষার জন্য নয়। আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদেরকে এছাড়া আর কোনো হুকুম দেওয়া হয়নি, তারা নিজেদের দীনকে একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার জন্য নির্ধারিত করে একনিষ্ঠভাবে একমাত্র আল্লাহর জন্যই ইবাদত করবে।’ (সূরা আল-বাইয়েনা : ৫) যারা নামাজ, রোজা ও জাকাত আদায় করে না, কিন্তু কোরবানির ক্ষেত্রে বড় বড় গরু, ছাগল কোরবানি দেয়, তাদের নিয়ত সঠিক নয় বা ভেজাল যুক্ত এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কোরবানির ক্ষেত্রে তাকওয়ার বিষয়টিও মানতে হবে বা সামনে রাখতে হবে। আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতায়ালা বলেন -পশু গুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছে না। মহান আল্লাহতাআলার কাছে পৌঁছে মনের তাকওয়া।’ সূরা আল-হজ্জ : ৩৭
কোরবানির দ্বিতীয় শর্তঃ
কোরবানি হতে হবে অবশ্যই প্রিয় নবীর অনুসরণ ও অনুকরণে। এর ব্যতিক্রম বা অন্যথা হলে নিয়ত ঠিক থাকলেও কোরবানি সহীহ হবে না। যিনি কোরবানি দিবেন অবশ্যই সে কোরবানি দাতার উপার্জন হালাল হতে হবে ।উপার্জনের টাকার কোনো গরমিল হলে বা হারাম হলে হাশরের ময়দানে ঐ ব্যক্তিকে এক কদমও সরতে দেওয়া হবে না। তার কোরবানি গ্রহণের প্রশ্ন তো দূরে থাক।
কোরবানির পশুটি অবশ্যই সুস্থ সবল হতে হবে বা যোগ্য প্রাণী সংগ্রহ করে কোরবানি দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রাণীর বয়সের দিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং নিরোগ হওয়ার বিষয়ে অবগত হতে হবে।
কোনো অংশীদারের নিয়ত গলদ হলেঃ
কোরবানির ভাগিদার বা অংশীদারদের কেউ যদি আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কোরবানি না করে, শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে বা লোক দেখানোর জন্য কোরবানি করে; তাহলে ওই ব্যক্তির কোরবানি শুদ্ধ হবে না। এমন ব্যক্তিকে অংশীদার বানালে বাকি অংশীদারদেরও কোরবানি হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অংশীদার নির্বাচন করা জরুরি। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৮, কাজিখান: ৩/৩৪৯)
যারা তিন ভাগ বা সাত ভাগে কোরবানি দেন তারা অবশ্যই শরিকদের বিষয় খোঁজখবর নিয়ে তারপর তাদের সাথে কোরবানির ভাগিদার হবেন। কেননা, কোনো এক শরিকের আয়ের অর্থ ভেজাল হলে সবার কোরবানি বাতিল হয়ে যাবে অর্থাৎ কোরবানি কবুল হবেনা ।
পশু কোরবানি দেয়ার পর ওজন না করে বা না মেপে অনুমান করে কোরবানির গোশত ভাগ করা যাবে না; অবশ্যই পাল্লা দিয়ে সঠিকভাবে মেপে ভাগ করতে হবে। যাতে কারো মনে কোনো সন্দেহের দানা না বাধে । অবশ্যই সঠিক ভাগে ভাগ করতে হবে।
পশুর জবেহ থেকে শুরু করে গোশত প্রস্তুত করা পর্যন্ত কোনো শ্রমিকের প্রাপ্য হক সঠিকভাবে আদায় না করে গোশত দিলে চলবে না। তবে তাঁর পারিশ্রমিক দেওয়ার পর অতিরিক্ত হিসেবে গোশত দেওয়া যাবে।
কোরবানি যেই ব্যাক্তির ওপর ওয়াজিব হয়েছে, তাঁর নিজের পক্ষ থেকে গোশত দেওয়ার পর অন্যদের পক্ষ থেকেও গোশত দিতে পারবেন। তবে নিজের পক্ষ থেকে না দিয়ে অন্যের পক্ষ থেকে দিলে তা সহিহ হবে না।
কোরবানির গোশত ধনী–গরিব সবাই খেতে পারে। কোরবানির সুন্নত হলো কিছু অংশ গরিব এবং পাড়া–প্রতিবেশীদের দেওয়া কিছু অংশ আত্মীয়স্বজনদের দেওয়া, এবং কিছু অংশ নিজের পরিবারের জন্য রাখা। তবে যত বেশি মানুষকে দেয়া যাবে, তত ভালো। অনেকে ৭ ভাগের ১ ভাগ গোশত পাড়া প্রতিবেশি আত্বীয়স্বজন ও গরিবদের দিয়ে থাকেন , অনেকে সামান্য কিছু রেখে পুরোটাই প্রতিবেশি আত্বীয়স্বজন ও গরিবদের মাঝে দিয়ে দেন । ত্যাগের কোরবানির গোশত নিজেদের ভোগের জন্য ফ্রিজে রাখা অনৈতিক ও অমানবিক।
বর্তমান সমাজের একটি প্রচলিত ভুল যা হলোঃ কোরবানি পশুটি জবেহর সময় আমরা সকলে বলে থাকি আমার নামে বা মায়ের নামে অথবা অমুকের নামে কোরবানি দিচ্ছি , কোরবানি হতে হবে আল্লাহর নামে। কোরবানি সহি-শুদ্ধ হওয়ার জন্য কথাটি হতে হবে এমন আমার পক্ষ থেকে, মায়ের পক্ষ থেকে অথবা অমুকের পক্ষ থেকে।
ঋনগ্রস্থ ব্যাক্তির জন্য কোরবানি ওয়াজিব হবে কি?
কুরবানি দেওয়ার মতো সম্পদ আছে এবং ওই পরিমান টাকার মালিক কিন্তু ঋণগ্রস্ত; এমন ব্যক্তির কুরবানির হুকুম কী? ঋনগ্রস্থ ব্যাক্তি কি কুরবানি দিতে পারবে? ঋনগ্রস্থ ব্যাক্তি কুরবানি না দিলে গোনাহ হবে ?
ঋনগ্রস্থ ব্যাক্তির কোরবানি দেয়ার ব্যাপারে ইসলামের দিকনির্দেশনাঃ
যে পরিমাণ সম্পদ থাকলে কুরবানি ওয়াজিব হয়; সেই পরিমাণ সম্পদের মালিক যদি ঋণগ্রস্ত হয়,তবে তার কোরবানি দেয়া ওয়াজিব কিনা তা নির্ভর করবে ঋনগ্রস্থ ব্যক্তির সকল সম্পদের হিসাবের ওপর।
>> কোরবানি দেয়ার পরিমাণ টাকা অথবা সম্পদের মালিক যদি ঋণগ্রস্ত হয়ে থাকে তবে দেখতে হবে তার- ঋণের পরিমাণ কত হতে পারে? ঋণ পরিশোধ করে দিলেও যদি ওই ঋণগ্রস্ত ব্যাক্তির ওই পরিমান সম্পদ থাকে, তাহলে কি তার কোরবানি নেসাব পরিমাণ হবে বা ওয়াজিব হবে?
১. ঋণগ্রস্ত ব্যাক্তি যদি তার ঋণ পরিশোধ করে দেই এবং তার কাছে কুরবানির সময়েও নেসাব পরিমাণ সম্পদ বা টাকা না থাকে তবে ওই ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য কুরবানি ওয়াজিব হবে না।
২. আর যদি ঋণগ্রস্ত ব্যাক্তি তার ঋন পরিশোধ করে দেওয়ার পরেও তার কাছে কুরবানির সময়ে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে, তবে ওই ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ওপর কোরবানি দেয়া ওয়াজিব ।
নেসাব পরিমাণ সম্পদ সারাবছর নিজের কাছে গচ্ছিত থাকা বা জমা থাকতে হবে এমনটি আবশ্যক নয়। বরং কোরবানির সময়ের দিনগুলোতে অর্থাৎ জিলহজ্ব মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখের মধ্যবর্তি সময়ে যদি কারো কাছে ঋণ ও বাৎসরিক পারিবারিক সকল খরচ করার পরও ওই ব্যাক্তির কাছে অতিরিক্ত অর্থ থাকে তবে তার ওপর কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব ।
কোরাবানি ওয়াজিব হওয়া পরিমান সম্পদের নেসাব হলো- সাড়ে ৫২ ভরি/তোলা রুপা।
পড়ুন - কোরবানি ও আকিকা দেয়ার ইসলামিক নিয়ম
এবং সাড়ে ৭ ভরি/তোলা স্বর্ণ
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ বোঝার তৌফিক দিন , এবং সবার কোরবানি কবুল করুন । আমিন।
তথ্যসূত্র – ntvbd ও jagonews24
লিখেছেনঃ উত্তর বাড্ডার ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসার আরবি বিভাগের প্রভাষক ।
0 Comments