পবিত্র ধর্মগ্রন্থ - কুরআনে মধুর কথা
আরবি পরিভাষায় মধুপোকা বা মৌমাছিকে ‘নাহল’(نحل) বলা হয়। পবিত্র কোরআনে এই নামে একটি স্বতন্ত্র সূরা বিদ্যমান আছে। সূরা নাহল এর আয়াত ৬৯-এ আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন--
"মৌমাছির পেট থেকে বিভিন্ন রঙের পানীয় নির্গত হয়। সেই পানীয়তে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার।"
মধু হচ্ছে ওষুধ এবং খাদ্য উভয়ই। মধুকে বলা হয়- বিররে এলাহি ও তিব্বে নব্বী। অর্থাৎ খোদায়ী চিকিৎসা ও নবী করীম (সা.)- এর বিধানের অন্তর্ভুক্ত। সূরা মুহাম্মদ- এর ১৫ আয়াতে আল্লাহ তায়ালার এরশাদ হচ্ছে- “জান্নাতে স্বচ্ছ মধুর নহর প্রবাহিত হবে।” খাদ্য ও ঋতুর বিভিন্নতার কারণে মধুর রঙ বিভিন্ন হয়ে থাকে। এ কারণেই যদি কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলে বিশেষ কিছু ফল এবং ফুলের প্রাচুর্য থাকে তবে এর প্রভাব এবং স্বাদ অবশ্যই সেখানে মধুতে পরিলক্ষিত হয়।
মধুর গুণাগুণ ও উপকারিতা
সাধারণভাবে বলা যায়- মধু হলো লাখ লাখ মৌমাছির অক্লান্ত শ্রম আর সেবাব্রতী জীবনের দান। মৌমাছিরা ফুলে ফুলে বিচরণ করে ফুলের রেণু ও মিষ্টি রস সংগ্রহ করে পাকস্থলীতে রাখে। তারপর সেখানে মৌমাছির মুখ নিঃসৃত লালা মিশ্রিত হয়ে রাসায়নিক জটিল বিক্রিয়ায় মধু তৈরি হয়। এরপর মুখ হতে মৌচাকের প্রকোষ্ঠে জমা করা হয়।
মধু হল এক প্রকারের মিষ্টি এবং ঘন তরল পদার্থ, যা মৌমাছি ও অন্যান্য পতঙ্গ ফুলের নির্যাস থেকে তৈরি হয় এবং মৌচাকে সংরক্ষীত হয়। এটি উচ্চ ঔষধিগুণ সম্পন্ন একটি ভেষজ তরল ; এটি সুপেয়। বিভিন্ন খাদ্য প্রস্তুতিতে এর ব্যবহারে চিনির চেয়েও অনেকগুন বেশি এবং এর অনেক সুবিধাও রয়েছে। এর বিশিষ্ট গন্ধের জন্য অনেকে চিনির চাইতে মধুকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের সুন্দরবনের মধু স্বাদ, রং, হালকা সুগন্ধ এবং ঔষধিগুণাবলীর জন্য বিক্ষাত। সুন্দরবনের বেশিরভাগ মধু কেওড়া গাছের ফুল থেকে উৎপন্ন হয়। সুন্দরবনের মাওয়ালী সম্প্রদায়ের লোকেরা মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে এবং তা বিক্রয় করে জীবন নির্বাহ করে। মধুর অন্য একটি গুণ হল এটি কখনো নষ্ট হয় না৷ হাজার বছরেও মধুর গুণাগুণ নষ্ট হয় না।
পুষ্টিগুণের দিকটি যদি বিবেচনা করে, আমরা খাবারের একটি তালিকা তৈরি করি, সে তালিকার প্রথম সারিতেই থাকবে ‘মধু’র নাম। মধু শরীরের জন্য অনেক উপকারী এবং নিয়মিত মধু খেলে অসংখ্য রোগবালাই থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। মধুর গুনাগুন বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণিত।
মধুর উপাদান
মধুতে রয়েছে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান। ফুলের পরাগের মধুতে থাকে ২৫ থেকে ৩৭ শতাংশ গ্লুকোজ, ৩৪ থেকে ৪৩ শতাংশ ফ্রুক্টোজ, ০.৫ থেকে ৩.০ শতাংশ সুক্রোজ এবং ৫ থেকে ১২ শতাংশমন্টোজ। আরও থাকে ২২ শতাংশ অ্যামাইনো অ্যাসিড, ২৮ শতাংশ খনিজ লবণ এবং ১১ শতাংশএনকাইম। এতে চর্বি ও প্রোটিন নেই। ১০০ গ্রাম মধুতে থাকে ২৮৮ ক্যালরি।
মধুর উপকারিতা সম্পর্কেঃ
মানব দেহের রোগ প্রতিরোধশক্তি বাড়ায় মধু : মধু শরীরের রোগ প্রতিরোধশক্তি বাড়াতে যেমন সহযোগিতা করে তেমনি আবার শরীরের ভেতরে এবং বাইরে যেকোনো ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা রাখে এই মধু। মধুতে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধকারী উপাদান রয়েছে , যা অনাকাঙ্ক্ষিত সংক্রমণ থেকে আমাদের দেহকে রক্ষা করে।
রক্ত পরিষ্কারক মধু: এক গ্লাস গরম পানির সঙ্গে এক বা দুই চামচ মধু ও এক চামচ লেবুর রস মেশান। এবং নিয়মিত এই মিশ্রণ খান। গরম পানি মধু ও লেবু একসাথে মিষিয়ে খেলে রক্ত পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। তা ছাড়া আমাদের শরিরের রক্তনালিগুলোও পরিষ্কার করে।
পানিশূন্যতায় মধু গুনাগুন: ডায়রিয়া সারাতে এক লিটার পানির সাথে ৫০ মিলিলিটার মধু মিশিয়ে খেলে দেহে পানিশূন্যতা রোধ করা যায়।
দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে মধু খুবই কার্য্যকরি : চোখের জন্য মধু অনেক উপকারি। মধুর সঙ্গে গাজরের রস মিশিয়ে নিয়মিত খেলে দৃষ্টিশক্তি বাড়ে।
রূপচর্চায় মধুর জুড়ি নেই: মেয়েদের রূপচর্চার মধুর ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়। নিয়মিত মধু খেলে ত্বকের মসৃণতা বৃদ্ধি পায় , ত্বক হয় উজ্জ্বল ও লাবন্যময়।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে মধু: মধুতে রয়েছে ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স। ভিটামিন - বি ,ডায়রিয়া ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়তা করে। ১ চা–চামচ খাঁটি মধু প্রতিদিন সকালে পান করলে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে আরোগ্য লাভ করা যায় ।
হজমে সহায়তা করে মধু: মধুতে যে শর্করা থাকে, তা সহজেই হজম হয়। কারণ, এতে যে ডেক্সট্রিন থাকে, তা সরাসরি রক্তে প্রবেশ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে ক্রিয়া করে। যাদের পেটের রোগের সমস্মাযা আছে তাদের জন্য মধু খুবই উপকারী।
রক্তশূন্যতায় মধু: মধু রক্তের হিমোগ্লোবিন গঠনে সহায়তা করে , মধু রক্তশূন্যতায় বেশ ফলদায়ক। কারণ, মধুতে আছে খুব বেশি পরিমাণে কপার, লৌহ ও ম্যাঙ্গানিজ।
ফুসফুসের যাবতীয় রোগ ও শ্বাসকষ্ট নিরাময়ে মধু: বলা হয়, ফুসফুসের যাবতীয় রোগে মধু উপকারী। যদি একজন অ্যাজমা (শ্বাসকষ্ট) রোগীর নাকের কাছে মধু ধরে শ্বাস টেনে নেওয়া হয়, তাহলে সে স্বাভাবিক এবং গভীরভাবে শ্বাস টেনে নিতে পারবে। অনেকে মনে করে, এক বছরের পুরোনো মধু শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য বেশ ভালো।
অনিদ্রায় মধু: মধু অনিদ্রার ভালো ওষুধ। রাতে শোয়ার আগে এক গ্লাস পানির সঙ্গে দুই চা–চামচ মধু মিশিয়ে খেলে এটি গভীর ঘুম ও সম্মোহনের কাজ করে।
যৌন দুর্বলতায় মধুর গুনাগুন : পুরুষদের মধ্যে যাদের যৌন সমস্যা রয়েছে, তাঁরা যদি প্রতিদিন মধু ও ছোলা মিশিয়ে খান, তাহলে খুবই দ্রুত যৌন সমস্যার সমাধান পাওয়া যায় ।
প্রশান্তিদায়ক পানীয় এই মধু: হালকা গরম দুধের সঙ্গে মিশ্রিত মধু একটি প্রশান্তিদায়ক পানীয়।
মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য রক্ষায় মধু: মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য রক্ষায় মধু ব্যবহৃত হয়। এটা দাঁতের ওপর ব্যবহার করলে দাঁতের ক্ষয়রোধ করে। দাঁতে পাথর জমাট বাঁধা রোধ করে এবং দাঁত পড়ে যাওয়াকে বিলম্বিত করে। মধু রক্তনালিকে সম্প্রসারিত করে দাঁতের মাড়ির স্বাস্থ্য রক্ষা করে। যদি মুখের ঘায়ের জন্য গর্ত হয়, এটি সেই গর্ত ভরাট করতে সাহায্য করে এবং সেখানে পুঁজ জমতে দেয় না। মধু মিশ্রিত পানি দিয়ে গড়গড়া করলে মাড়ির প্রদাহ দূর হয়।
পাকস্থলীর সুস্থতায় মধু: মধু পাকস্থলীর কাজকে জোরালো করে এবং হজমের গোলমাল দূর করে। এর ব্যবহার হাইড্রোক্রলিক অ্যাসিড ক্ষরণ কমিয়ে দেয় বলে অরুচি, বমিভাব, বুকজ্বালা এগুলো দূর করা সম্ভব হয়।
আমাশয় ও পেটের পীড়া নিরাময়ে মধু: যাদের পেটের অনেক পুরাতন আমাশয় এবং পেট ব্যাথার মতো জটিল সমস্য আছে তারা নিয়মিত মধু খেলে পেটের রোগ থেকে নিরাময় হয় ।
হাঁপানি রোধে মধু: আধা গ্রাম গুঁড়ো করা গোলমরিচের সঙ্গে সমপরিমাণ মধু এবং আদা মেশান। দিনে অন্তত তিনবার এই মিশ্রণ খান। এটা হাঁপানি রোধে সহায়তা করে।
উচ্চ রক্তচাপ কমায় মধু: দুই চামচ মধুর সঙ্গে এক চামচ রসুনের রস মেশান। সকাল-সন্ধ্যা দুইবার এই মিশ্রণ খান। প্রতিনিয়ত এটার ব্যবহার উচ্চ রক্তচাপ কমায়। প্রতিদিন সকালে খাওয়ার এক ঘণ্টা আগে খাওয়া উচিত।
রক্ত উৎপাদনে সহায়তা মধু: রক্ত উৎপাদনকারী উপকরণ আয়রন রয়েছে মধুতে। আয়রন রক্তের উপাদানকে (আরবিসি, ডব্লিউবিসি, প্লাটিলেট) অধিক কার্যকর ও শক্তিশালী করে।
হৃদ্রোগে সারাতে মধু: এক চামচ মৌরি গুঁড়োর সঙ্গে এক বা দুই চামচ মধুর মিশ্রণ হৃদ্রোগের টনিক হিসেবে কাজ করে। এটা হৃৎপেশিকে সবল করে এবং এর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
শরিরের তাপ বৃদ্ধি করে মধু: প্রচন্ড শিতের সময় মধু শরীরকে গরম রাখে। প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে এক চামচ অথবা দুই চা–চামচ মধু এক কাপ ফুটানো পানির সঙ্গে মিশিয়ে খেলে শরীর থাকে ঝরঝরে ও তাজা ।
ওজন কমাতে মধু: মধুতে কোনো চর্বি না থাকায়। পেট পরিষ্কার রাখে, পেটের চর্বি কমায়, ফলে শরিরের ওজন কমে।
গলার স্বর: নিয়মিত মধু খেলে বা প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হাতের তালুতে এক চা চামচ মধু নিয়ে চেটে চেটে খেলে গলার স্বর সুন্দর ও মধুর হয়ে ওঠে।
তারুণ্য বজায় রাখতে মধু: ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে মধুর কোনো বিকল্প নেই। মধুতে থাকা অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট, যা ত্বকের রং ও ত্বক সুন্দর করে। ত্বকের ভাঁজ পড়া ও বুড়িয়ে যাওয়া রোধে সহায়তা করে। শরীরের সামগ্রিক শক্তি ও তারুণ্য বাড়াতে খুবই কার্য্যকরি ভূমিকা পালন করে।
হাড় ও দাঁত গঠনে মধু: মধুতে রয়েছে প্রচুর ক্যালসিয়াম যা মধুর গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ । ক্যালসিয়াম দাঁত, হাড় ও চুলের গোড়া শক্ত রাখে, নখের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করে, ভঙ্গুরতা রোধ করতে সহায়তা করে।
রক্তশূন্যতা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে মধু: মধুতে থাকা ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স, যা রক্তশূন্যতা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে খুবই কার্য্যকরি ভূমিকা পালন করে।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ
আরও জানুন -
তুলসী পাতার উপকারিতা ও তুলসী পাতা খাওয়ার নিয়ম
লেবু খাওয়ার উপকারিতা ও লেবুর পুষ্টিগুন
গরম পানি খাওয়ার নিয়ম ও গরম পানির উপকারিতা
লাল চা খাওয়ার নিয়ম ও লাল চায়ের উপকারীতা
বৃষ্টির পানির উপকার ও ব্যবহারের নিয়ম
দাতের ব্যথায় করনীয় এবং ঘরোয়া টোটকামাইগ্রেন কি কেনো হয় এবং হলে করনীয় কি
মধুর ব্যবহারে সাফল্যতা
প্রাচীন গ্রিসের খেলোয়াড়েরা মধু খেয়ে মাঠে নামতো ; কারণ মধুতে রয়েছে উচ্চমাত্রার ফ্রুক্টোজ ও গ্লুকোজ যা যকৃতে গ্রাইকোজেনের রিজার্ভ গড়ে তোলে। রাতে ঘুমানোর আগে মধু খেলে মস্তিষ্কের ক্রিয়াক্ষমতা ভালো থাকে। নিয়মিত মধু পানে রোগ-বালাই হ্রাস পায় কেননা মধু মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ঠাণ্ডায় মধু ভালো কাজ করে ; পেনসিলভেনিয়া স্টেট কলেজের পরীক্ষায় দেখা গেছে বাজারে যত ঔষধ পাওয়া যায় তার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর এক চামচ মধু। মধুর ভাইরাস প্রতিরোধী ক্ষমতা উচ্চ। মধু হজমে সাহায্য করে। পেটরোগা মানুষদের জন্য মধু বিশেষ উপকারী। প্রাচীন কাল থেকে গ্রিস ও মিশরে ক্ষত সারাইয়ে মধু ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ২০০৭-এ সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পরীক্ষায় দেখা গেছে অধিকাংশ ক্ষত ও জখমের উপশমে মধু ডাক্তারী ড্রেসিং-এর চেয়েও বেশি কার্যকর। অগ্নিদগ্ধ ত্বকের জন্যও মধু খুব উপকারী।
1 Comments
very very helpfull
ReplyDelete